খুলনা শহরের বাগমারা এলাকার বাসিন্দা জেবুনেসাই শুধু সংকটে সংসারের হাল ধরেছেন তা নয়। দেশের বহু নারীই তাঁর মতো সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এক দশক আগেও গ্রামে নারীদের আয়ের উৎস ছিল মূলত হাঁস-মুরগি পালন বা কাঁথা সেলাই করা। আর শহরে নারীরা স্কুলে শিক্ষকতা, টিউশনি বা ঘরে বসে মেশিনে কাপড় সেলাই করে আয় করতেন। দিন বদলেছে, এখন নারীরা ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করছেন। সংসারের খরচ জোগাড়ে অনেক নারীর আয় এখন অপরিহার্য। নারীর এগিয়ে চলার সাহস বেড়েছে।
প্রায় ৯ দশক আগে ‘অবরোধবাসিনী’দের দুঃখগাথা রচনা করেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। দেখিয়েছিলেন কিভাবে আশৈশব অন্ধকার গৃহকোণে জীবন কাটিয়ে ‘অবরোধ প্রথার সম্মান’ দিয়েছেন এ দেশের নারীরা। ‘অন্ধ বোরকায়’ আপাদমস্তক ঢেকে পরিচারিকার পাহারায় ৯ বছরের শিশুর স্কুলে যাওয়া, বিয়ের আগে বালিকা কনেকে ‘মাইয়াখানা’য় বন্দি রাখা, মোটা কাপড়ে মোড়া পালকির মধ্যে ‘মালগাড়ি’তে নারীর ট্রেন ভ্রমণের সেই অন্ধকার ইতিহাস পেছনে ফেলে বেগম রোকেয়ারই ‘সুলতানার স্বপ্ন’র পথে হাঁটছে নারী, নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজনীতি, প্রশাসনসহ সব অঙ্গনে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের বিরোধী নেতা নারী। নারীরা এখন বন্দুক কাঁধে যুদ্ধ করছেন, বিমান চালাচ্ছেন, পাহাড়ে উঠছেন। শিক্ষকতা, চিকিৎসা, সাংবাদিকতা, আইন পেশা কোথায় নেই নারী। রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৭০ শতাংশ কর্মীই নারী। নারীরা গড়ে তুলছেন নতুন শিল্প-কারখানা। মাটি কাটছেন, ইট ভাঙছেন, জমিতে ফসলও বুনছেন। গাড়ি চালাচ্ছেন। প্রশাসনে নারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নারী। করপোরেট হাউস, ব্যাংক ও গবেষণায় নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর পর সিপিডির প্রথম নারী নির্বাহী পরিচালক হিসেবে আমি দায়িত্ব পাই। নারীর বাধা আছে। তবে দিন দিন তা কমছে।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান ভালো। বাধা আছে, তবে তার মধ্যে নারী এগিয়ে চলেছে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশের নারীদের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বেড়েছে। বিশেষভাবে কৃষি ও তৈরি পোশাক শিল্পে, উদ্যোক্তা হিসেবে নারীরা অবদান রাখছে। কম্পিউটার, প্রযুক্তি খাতেও আগ্রহী হচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, পাঁচ বছর আগে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল এক কোটি ৬০ লাখ। সেটি বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৮৩ লাখ।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ৬২ শতাংশ নারী আয়বর্ধক কাজে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি সর্বোচ্চ হার।
বাংলাদেশের নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণায়ও।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) ২০২০ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের নারীর অগ্রগতি বা পিছিয়ে পড়ার তুলনা করা হয়েছে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রথম প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে সেই চিত্র তুলে ধরা হয়। ফোরামের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চারটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক নম্বর অবস্থানে আছে। এগুলো হচ্ছে মেয়েদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় তালিকাভুক্তি, জন্মের সময় ছেলে ও মেয়ে শিশুর সংখ্যাগত সমতা এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্বে নারী। তবে নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ এবং স্বাস্থ্য ও আয়ুসহ আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নারী-পুরুষের সমতা : ডাব্লিউইএফের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে বিশ্বের ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ৫০তম। নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশ এক দশকে ২০ ধাপ এগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান বাংলাদেশের। ২০১৭ সালে বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭২তম স্থানে ছিল। ২০০৬ সালে ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন : ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ৭ নম্বরে রাখা হয়েছে। ২০০৬ সালে ছিল ১৭তম স্থানে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের তিনটি উপসূচকের মধ্যে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬তম এবং নারী মন্ত্রীর সংখ্যার দিক থেকে ১২৪তম। নারী সরকার প্রধানের দিক দিয়ে বিশ্বসেরা হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান জাতীয় সংসদের ৩০০ সাধারণ আসনে নির্বাচিত নারী সদস্যের সংখ্যা ২৩। এ ছাড়া সংরক্ষিত আসনে রয়েছেন আরো ৫০ জন। জাতীয় সংসদের স্পিকারও একজন নারী।
শিক্ষায় মেয়েরা : ফোরামের ওই প্রতিবেদন মতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণে সব দেশকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ড. রাশেদা কে. চৌধূরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়লেও উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ এখনো আশানুরূপ নয়।’
অন্যান্য ক্ষেত্রে : বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাওয়া তথ্য অনুসারে, সারা দেশে নিম্ন আদালতে এক হাজার ৮৫০ জন বিচারকের মধ্যে নারী ৫৫০ জন। সুপ্রিম কোর্টের ৯৯ জন বিচারপতির মধ্যে নারী সাতজন। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদি নিয়মিত কোর্সে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে সেনাবাহিনীতে নারী কর্মকর্তা ও সৈনিকের সংখ্যা আনুমানিক তিন হাজার ৭০০। নৌবাহিনীতে নারী কর্মকর্তা রয়েছেন মোট ১১৬ জন। তাঁরা সর্বোচ্চ কমান্ডার পদে কর্মরত। বিমানবাহিনীতে নারী সদস্য ২৯৫ জন। বাংলাদেশ পুলিশে নারী সদস্যসংখ্যা ১৪ হাজার ৪৮০, যা মোট জনবলের ৭.৫৫ শতাংশ। অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) হিসেবে কর্মরত আছেন পাঁচজন নারী। প্রশাসন ক্যাডারে সরকারের সচিব পদে আটজন, সচিব পদমর্যাদায় দুজন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৭১ জন, মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে সাতজন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে ৩৯ জন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে ১৩৯ জন নারী কর্মরত।
প্রতিবন্ধকতা এখনো আছে : এখনো অনেক পরিবারে মেয়ের চেয়ে ছেলেকে সুবিধা বেশি দেওয়া হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে বেশি কাজ করেও নারীকে বেতনসহ বিভিন্ন সুবিধা কম দেওয়া হয়। নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার মূল্যবোধ বিস্তৃত হয়নি। এখনো এ দেশে নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। এক গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষরা দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ জমির মালিক, বাকি মালিকানা নারীদের। পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা জুম চাষ করলেও ভূমির মালিকানা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। পারিবারিক শ্রমের ব্যাবহারিক মূল্য দেওয়া হলেও অর্থনৈতিক মূল্য এখনো স্বীকৃত নয়। মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) তা ধরা হয় না। নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে দেশের এমন একাধিক সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ নারী স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়। এ ছাড়া ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ৫৩ শতাংশ অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘এখনো আমাদের দেশে নারীদের অনেকে হেয় করে। নারী নির্যাতন ও সহিংসতা এখনো আছে। নারী নির্যাতন বন্ধ করতে যেসব আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ সই করেছে, তার সব ধারা কার্যকর করতে হবে। এ জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করতে হবে।’
মন্তব্য